বনলতা সেন কিংবা অসমাপ্ত কবিতা

১. 

ভার্সিটি লাইফে প্রথম দিন গিয়েছিলাম ভার্সিটির বাসে। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছিলাম এলাকার বড়ভাই-বোনেরা বার্সিটির বাসে করে ক্যাম্পাসে যেত। ভার্সিটির বাসগুলোর প্রতি আকর্ষণ মূলত তখন থেকেই। এইএচএসি পাশ করে শহরে এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দারুণ পুলকিত ছিলাম শুধু এজন্যই যে আমিও এখন থেকে ভার্সিটির বাসে চড়বো। তো প্রথমদিন বাসে ওঠে সেই ভাব নিয়ে বসে ছিলাম। আমাদের ক্যাম্পাস ছিলো বাসা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। প্রায় বিশ কিলোমিটার যাওয়ার পর অনেকগুলো স্টপেজ পেরিয়ে একটা স্টপেজে বাসটি থামলো। তিনটা ছেলে ও একটা মেয়ে উঠল বাসে। মেয়েটি ওঠে বসলো আমার বিপরীত সিটে। আমি মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
সেদিন ফেরার সময়ও কাকতালীয়ভাবে মেয়েটি আমার বিপরীত সিটে বসলো। বাস ছাড়ার পর বন্ধুদের সাথে আমি খুব রসিকতা করছিলাম, তারাও আমার সাথে করছিলো। ইদানিং সিরিয়াস মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেলেও আমি সে সময় খুব রসিক ছিলাম, হাসাতে পারতাম সবাইকে। তো আমার কথা শুনে সবাই হাসছিলো। হঠাৎ কী একটা কথা শুনে মেয়েটি রেগে গেলো, হয়তো ভাবলো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছি। চরম রাগ নিয়ে আমাকে বলতে শুরু করলো, কোন কলেজ থেকে এসেছ, এভাবে ফাজলামি করছ কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। পাক্কা মিনিট তিনেক আমাকে ঝাড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। ঘোর কাটার পর যখন কিছু বলতে যাব তখনই মেয়েটার স্টপেজ এসে গেলো। সে হনহন করে হেঁটে বাস থেকে নেমে গেলো। আমিও আমার বন্ধুরা শুধুই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম, কেউ কিছুই বলতে পারলাম না।

২. 

পরদিন বাসে ওঠার পর রাগে গা-জ্বলছিলো। গতকালের অপমানের প্রতিশোধ নেব ভেবে বসে ছিলাম। কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকাতেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় মন আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। মুহূর্তেই সব রাগ মাটি হয়ে গেলো। তাকালাম ভালো করে মেয়েটির দিকে। দেখলাম শ্যামলা বর্ণের মেয়ে হলেও চেহারায় অদ্ভুত এক মায়া আছে তার। ভালো করে না তাকালে বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম তাকে। গতকাল আমার সাথে কী করেছিলো ভুলে গেলাম সব। ক্যাম্পাসে গিয়ে ওর পরিচয় জানতে উদগ্রীব হয়ে গেলাম। ফলো করে দেখলাম ফিজিক্স
ডিপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছে। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম, কিন্তু ফিজিক্সে আমার কলেজের দুজন বন্ধু ছিলো। তাদেরকে ওর সম্পর্কে জানাতে অনুরোধ করলাম। তারা পরদিন জানালো মেয়েটির নাম অর্পিতা। অর্পিতা সেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, এখন একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালান। পরিবারে মা, বাবা আর ছোট একটা ভাই আছে শুধু। ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্রী সে, সেই সাথে ভালো গান গায়।

সব জেনে ওর সাথে কথা বলার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কিন্তু কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। যদি আমাকে সেদিনের মত আবারও ভুল বোঝে, আবারও ঝাড়ি দেয় এই ভয়ে টতস্থ থাকতাম। এভাবে একটা সেমিস্টার চলে গেলো। অর্পিতাকে শুধু দূর থেকে দেখেই যাচ্ছিলাম, কথা বলার সুযোগই পাচ্ছিলাম না।

একদিন ওদের ডিপার্টমেন্টে ঘুরঘুর করছিলাম। ওকে একটু দেখার আশায়ই মূলত ফিজক্স ডিপার্টমেন্টে যেতাম। হঠাৎ শুনি কে যেন মিষ্টি গলায় গান গাইছে। গানের কথা হলো সামিনা চৌধুরীর জনপ্রিয় গান, আমার মাঝে নেই এখন আমি। গিয়ে দেখি সেমিনার রূমের একটা বেঞ্চে অর্পিতা ও আরও দুটো মেয়ে বসে আছে, অর্পিতাই গাইছে। গানটি শুনে এত মুগ্ধ হলাম যে ইচ্ছে করছিলো বড় করে ধন্যবাদ দিই। কিন্তু তখনও সাহস পেলাম না। সেদিন বাসায় যাওয়ার সময় ও যখন বাস থেকে নামলো, আমি বাসের গেটে এসে বাস ছাড়ার সময় জোরে বললাম, গানের জন্য অনেক ধন্যবাদ। সে তাকালো আমার দিকে, একটা ছোট্র হাসি দিয়ে চলে গেলো।

৩. 

আমি ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতাম। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভক্ত ছিলাম। সবসময় তাঁর বই আমার সাথে থাকত। সুযোগ পেলেই পড়তাম। বিশেষ করে বনলতা সেন আমার প্রিয় কবিতা ছিলো, মুখস্ত ছিলো কবিতাটি। আবৃত্তিও করেছি অনেক জায়গায়। সে সময় একটা সাহিত্য সংগঠন ছিলো আমাদের। অনিয়মিত একটা লিটল ম্যাগ বের করতাম। সেবার বিজয় দিবসে একটা সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সম্পাদনার দায়িত্ব আমার ওপর ছিলো। সে সংখ্যায় অর্পিতাকে নিয়ে একটা রূপক কবিতা লিখেছিলাম আমি। একদিন ক্যাম্পাসে একা পেয়ে ভয়ে ভয়ে লিটল ম্যাগের একটা সংখ্যা তাকে দিয়ে ফেললাম। সে একটু ভেবে হাতে নিলো এবং ব্যাগেও রাখলো। কিন্তু আমি এরপর আর তার সামনে পড়তে চাইতাম না, যদি কবিতাটি বুঝে ফেলে আমাকে আবারও ঝাড়ি দেয়! কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ আমার কাছে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন আসে। পরিচয় পেতেই হার্টবিট বেড়ে যায় আমার। অর্পিতা আমার লিটল ম্যাগে প্রকাশ হওয়া কবিতাটির প্রশংসা করে এবং আমাকে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। পরদিন একটি কফিশপে দেখা করতে বলে। সেই থেকেই আমাদের ভালোলাগার শুরু হয়। আমি ওর গানের ভক্ত হিসেবে এবং ও আমার লেখার ভক্ত হিসেবে দুজন দুজনার খুব কাছাকাছি চলে আসি। খুব ভালোবেসে ফেলি একে-অপরকে। গভীর প্রণয়ে এত মগ্ন হয়ে যাই যে, ভুলে যাই সকল সামাজিকতা ও ধর্মীয় বিধিবিধানও।

৪. 

আমি মুসলিম, ও হিন্দু। দুজন দুই ধর্মের হওয়ায় কারও পরিবারই রাজি হয়নি আমাদের সম্পর্কে। উলটো জানাজানি হওয়ার পর দুজনের ওপর নিষেধাজ্ঞার বহর ছুটে আসে। গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর দুজনে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় মাদক বহনের দায়ে। আমার পকেট থেকে উদ্ধার (!) করা হয় কয়েক পিস ইয়াবা। মাদক মামলায় জেল খাঁটি প্রায় তিনমাস, এরপর জামিন হয়। জেল থেকে বেরিয়ে শুনি অর্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে এক আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে। কষ্টে বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ভালোবাসার জন্য জীবনে সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি যে আমি, সে আমি জেল খাটলাম মাদক-বহনের দায়ে। অথচ সে ভালোবাসাটাকেই পেলাম না! যখন শুনলাম অর্পিতার অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার বাবা নিজের ইনফ্লুয়েন্স কাজে লাগিয়ে আমাকে জেলে পাঠিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন, তখন ইচ্ছে করছিলো পুরো পৃথিবীটাকে তছনছ করে দিই। কিন্তু সব ইচ্ছে কি পূরণ হয় মানুষের? হয় না।

৫. 

জেল থেকে বেরিয়ে অর্পিতার স্বামীর বাড়ির ঠিকানা অনেক খুঁজেও পাইনি। যেদিন পেলাম, সেদিন গিয়ে শুনি স্বামীর সাথে আমেরিকা চলে গেছে। এরপর আর তার খোঁজও রাখিনি। আমিও সাহিত্য টাহিত্য বাদ দিয়ে বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিলাম। অর্পিতা সেনকে ভালোবেসে আমি ডাকতাম বনলতা সেন৷ প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো শোনাতাম তাকে। যখন আকাশলীনা কবিতার ঐ লাইনটি বলতাম, কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? তখন রেগে যেত সে। বলতো আমার তুমি ছাড়া আর কারও সাথে কোনো কথা নেই, আমি আকাশলীনা নই, আমি বনলতা সেন, তোমার বনলতা সেন। আজ আমি অর্পিতাকে বলতে চাই, জীবনে কবিতা লিখেছি অনেক। কিন্তু আমার জীবনের কবিতাটি আজও অসমাপ্ত রয়ে গেলো। জীবনকাব্যের ছন্দ হারানো এই আমি আজ ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ
চৌধুরীর সুরে গাইতে চাই - জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আজও আমি, সবকিছু ভুলে যেন করি লেনদেন/তুমিও তো বেশ আছ ভালোই আছ, কবিতায় পড়া সেই বনলতা সেন...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ