টানা একমাস কক্সবাজারে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসছে সায়েম। এই একমাস সে তার মনের সাথে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করেছে। প্রতিদিন সমুদ্র সৈকতে বসে ভাবনার অতলে হাবুডুবু খেয়েছে। তবু সে জিনিয়াকে ভুলে যেতে পারেনি। সায়েম ভাবতেও পারেনি জিনিয়া তার সাথে এমন করবে! কারণ সে যখন স্থানীয় রাজনীতি আর খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে
নিজেকে ক্রমেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই জিনিয়া বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার আহবানে তাকে আবারো আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। জিনিয়ার ভালোবাসাই তাকে সৎভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিল। খারাপ বন্ধু আর স্থানীয় রাজনীতিকদের সংস্পর্শ ছেড়ে দিয়ে সে গত তিন বছরে নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিল। ভেবেছিল আর মাত্র দুটো বছর পর নিজেকে আরো পরিণত করে, আরো ভালভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই জিনিয়ার বাবার সামনে দাঁড়াবে সে। কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলবে সে ভাবতেও পারেনি। কোন পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ জিনিয়া এসে বলে বসল ‘সায়েম আমাকে তুমি ভুলে যাও। আমি আমার বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করব এবং আগামি শুক্রবারেই আমার বিয়ে’। শুনে সায়েমের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই জিনিয়াকে সজোরে চড় মেরে বসে সে! চড় খেয়ে জিনিয়া অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। তারপর সায়েমকে হাতজোড় করে বলল ‘প্লিজ সায়েম তুমি জানতে চেও না আমি কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছি। শুধু মনে রেখো আমি তোমাকেই ভালোবাসি এবং তোমাকেই ভালোবেসে যাব। আমার আরেকটা অনুরোধ, তুমি প্লিজ এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যাও’। তারপর জিনিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে চলে গেল। সায়েম পেছন থেকে একবারও ডাকেনি জিনিয়াকে। কারণ সে জানে যে চলে যেতে চায়, তাকে ডেকে কখনোই ফেরানো যায় না! ওইদিনই সায়েম চলে আসে কক্সবাজারে। পুরো একমাস কাটিয়ে সে ঢাকায় ফিরে আসছে আর বাসে বসে ভাবছে সে আবার আগের মতো খারাপ হয়ে যাবে। নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেবে!
২.
ছয় বছর পর। সায়েম তার ভাবনামতই কাজ করেছে। সে এখন এলাকার ‘টপ ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় রাজনীতিকরা সায়েমকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে। হেন খারাপ কাজ নেই, যা সায়েমকে দিয়ে তারা করায় না। এলাকায় একটা গ্রুপ আছে সায়েমদের। সে ওই গ্রুপের লিডার। তাদের গ্রুপের কাজ হলো স্থানীয় রাজনীতিকদের খারাপ কাজগুলো চুক্তিতে করে দেয়া। এসব করে তারা অনেক টাকা ইনকাম করে। সাথে সবধরনের মাদকও সমানে গ্রহণ করে। ফলে টাকার টানাটানি সবসময়ই লেগে থাকে তাদের। এজন্য কোনো কাজই করতে তারা পিছপা হয় না। ওই ঘটনার পর কক্সবাজার থেকে ফিরে সায়েম তার দোকানটা বিক্রি করে দেয়। এরপর এই কাজগুলো সে শুরু করে। নিজেকে প্রতিনিয়ত নিঃশেষ করতে থাকে। তিন বছরের মাথায় সায়েমের বাবা মারা যান। তার মা ছোটবেলায়ই মারা গিয়েছিলেন। বাবা আরেকটা বিয়ে করায় সায়েমের ঘরে সৎ মা আর ভাইবোনও আছে। কিন্তু ঘরের প্রতি সে সবসময়ই উদাসীন থাকে। গেল ছয় বছরে একদিনের জন্যও নিজে থেকে জিনিয়ার খোঁজ নেয়নি। শুধু বছরদুয়েক আগে লোকমুখে শুনেছিল জিনিয়ার একটা মেয়ে হয়েছে।
৩.
একদিন ভরদুপুরে গলির মোড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল সায়েম। হঠাৎ তার সেলফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে উঠে একটি অতিচেনা নারীকন্ঠ।
-হ্যালো সায়েম, কেমন আছ? আমি জিনিয়া। চিনতে পেরেছো?
-কী চাও? কেন ফোন করেছ? গর্জে ওঠে সায়েমের কন্ঠ।
-তোমার সাথে আমার একবার দেখা করা খুবই দরকার। জানি আমার উপর তোমার অনেক রাগ, তবু আমার অনুরোধ তুমি আমার সাথে দেখা করো- অনুনয় বিনয় করে বলে জিনিয়া।
-তোমার সাথে আমার কোনো দরকার নেই। সব দরকার ছয় বছর আগেই ফুরিয়ে গেছে। এখন তুমি আর আমি দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। সুতরাং আমাকে আর বিরক্ত করো না প্লিজ!
-সায়েম, আমার সামনে এসে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলো, যা ইচ্ছে তাই করো। শুধু প্লিজ আমার সাথে দেখা করো- বলে এবার কেঁদেই ফেলে জিনিয়া।
-ওকে জিনিয়া, কান্নাকাটি থামিয়ে বলো কোথায়, কখন দেখা করতে চাও?
-এখনই। আমার ফ্ল্যাটে চলে আসো। কেউ নেই। শুধু আমি আর আমার ছোট্র মেয়েটা ছাড়া।
-ওকে আমি আসছি।
সায়েম জিনিয়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে দিল জিনিয়াই। কিন্তু জিনিয়াকে দেখে সায়েম খুবই আশ্চর্য হল। সে এ কোন জিনিয়াকে দেখছে! এত সুন্দরী একটা মেয়ে এমন অসুন্দর, মলিন হয়ে গেল কেমন করে!
-কী দেখছ সায়েম?
-না, কিছু না।
-কিছু তো অবশ্যই।
-না, দেখলাম তুমি অনেক বদলে গেছ।
-তুমিও তো বদলে গেছ!
-আমি তো বদলাবই। কারণ আমি খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষেরা প্রতিনিয়তই বদলায়! এবার বল কীজন্য ডেকেছো?
-সায়েম তুমি আজ খারাপ হয়েছ কেন? এই আমার জন্য। আমি পাপী সায়েম। অনেক পাপী। অবশ্য আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েও গেছি। কারণ আমার স্বামী গত মাসের দশ তারিখে ব্ল্যাড ক্যান্সারে মারা গেছে। এখন আমি আবারও একা। তাই তোমাকে ডেকে এনেছি ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কারণ তোমার প্রতি আমি যে অবিচার করেছি, আল্লাহ তার শাস্তি আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তবু আমি অপরাধী। সেই অপরাধের জন্য আমি এখন অনেক বেশি অনুতপ্ত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও সায়েম। আরেকটা কথা-তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানি না। আমি ওই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে কখনোই কল্পনাও করতে পারিনি আমার জীবনে। কিন্তু বিশেষ একটা পরিস্থিতিতে আমার বাবা আমাকে ওই বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন। বিয়ের পর আমি আল্লাহর দরবারে
প্রতিদিন কাঁদতাম যেন আমি ওই লোকটার কাছ থেকে মুক্তি পাই। আল্লাহ বোধহয় আমার ডাক কবুল করেছেন। নয়তো এই অল্প বয়েসেই লোকটা মারা যাবে কেন! কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে লাগল জিনিয়া।
-শোনো জিনিয়া, তোমার প্রতি আমার একসময় অনেক রাগ থাকলেও এখন আর কোনো রাগ নেই। আমি তোমাকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি চেয়েছি তুমি সুখেই থাকো। তাই কখনোই তোমার খবর জানতে চাইনি। কিন্তু তুমি সুখী হতে পারোনি দেখে আমি নিজেই এখন অনুতপ্ত। আমার আর কোন দুঃখবোধ নেই তোমার প্রতি। আমি চাই তুমি তোমার মেয়েটাকে নিয়ে আজীবন সুখেই থাকো। আমি আমার এই নষ্ট জীবন নিয়েই বেঁচে থাকব। আরেকটা কথা, কখনো যদি জীবন পথে চলতে গিয়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হও আর দেখো সমস্যাটা আমার দ্বারা সমাধান হবে তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে বোলো। আমি তোমাকে সাহায্য করব। এবার আসি জিনিয়া। ভালো থেকো, অনেক ভালো- বলেই দ্রুত বেগে চলে যেতে লাগল সায়েম। পেছন থেকে কান্নামাখা কন্ঠে জিনিয়া বলতে লাগল, সায়েম প্লিজ তুমি যেওনা, আমার আরও কথা আছে, প্লিজ!
কিন্তু সায়েম পেছন ফিরে একটুও না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে যেতে লাগল....
-হ্যালো সায়েম, কেমন আছ? আমি জিনিয়া। চিনতে পেরেছো?
-কী চাও? কেন ফোন করেছ? গর্জে ওঠে সায়েমের কন্ঠ।
-তোমার সাথে আমার একবার দেখা করা খুবই দরকার। জানি আমার উপর তোমার অনেক রাগ, তবু আমার অনুরোধ তুমি আমার সাথে দেখা করো- অনুনয় বিনয় করে বলে জিনিয়া।
-তোমার সাথে আমার কোনো দরকার নেই। সব দরকার ছয় বছর আগেই ফুরিয়ে গেছে। এখন তুমি আর আমি দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। সুতরাং আমাকে আর বিরক্ত করো না প্লিজ!
-সায়েম, আমার সামনে এসে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলো, যা ইচ্ছে তাই করো। শুধু প্লিজ আমার সাথে দেখা করো- বলে এবার কেঁদেই ফেলে জিনিয়া।
-ওকে জিনিয়া, কান্নাকাটি থামিয়ে বলো কোথায়, কখন দেখা করতে চাও?
-এখনই। আমার ফ্ল্যাটে চলে আসো। কেউ নেই। শুধু আমি আর আমার ছোট্র মেয়েটা ছাড়া।
-ওকে আমি আসছি।
সায়েম জিনিয়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে দিল জিনিয়াই। কিন্তু জিনিয়াকে দেখে সায়েম খুবই আশ্চর্য হল। সে এ কোন জিনিয়াকে দেখছে! এত সুন্দরী একটা মেয়ে এমন অসুন্দর, মলিন হয়ে গেল কেমন করে!
-কী দেখছ সায়েম?
-না, কিছু না।
-কিছু তো অবশ্যই।
-না, দেখলাম তুমি অনেক বদলে গেছ।
-তুমিও তো বদলে গেছ!
-আমি তো বদলাবই। কারণ আমি খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষেরা প্রতিনিয়তই বদলায়! এবার বল কীজন্য ডেকেছো?
-সায়েম তুমি আজ খারাপ হয়েছ কেন? এই আমার জন্য। আমি পাপী সায়েম। অনেক পাপী। অবশ্য আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েও গেছি। কারণ আমার স্বামী গত মাসের দশ তারিখে ব্ল্যাড ক্যান্সারে মারা গেছে। এখন আমি আবারও একা। তাই তোমাকে ডেকে এনেছি ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কারণ তোমার প্রতি আমি যে অবিচার করেছি, আল্লাহ তার শাস্তি আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তবু আমি অপরাধী। সেই অপরাধের জন্য আমি এখন অনেক বেশি অনুতপ্ত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও সায়েম। আরেকটা কথা-তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানি না। আমি ওই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে কখনোই কল্পনাও করতে পারিনি আমার জীবনে। কিন্তু বিশেষ একটা পরিস্থিতিতে আমার বাবা আমাকে ওই বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন। বিয়ের পর আমি আল্লাহর দরবারে
প্রতিদিন কাঁদতাম যেন আমি ওই লোকটার কাছ থেকে মুক্তি পাই। আল্লাহ বোধহয় আমার ডাক কবুল করেছেন। নয়তো এই অল্প বয়েসেই লোকটা মারা যাবে কেন! কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে লাগল জিনিয়া।
-শোনো জিনিয়া, তোমার প্রতি আমার একসময় অনেক রাগ থাকলেও এখন আর কোনো রাগ নেই। আমি তোমাকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি চেয়েছি তুমি সুখেই থাকো। তাই কখনোই তোমার খবর জানতে চাইনি। কিন্তু তুমি সুখী হতে পারোনি দেখে আমি নিজেই এখন অনুতপ্ত। আমার আর কোন দুঃখবোধ নেই তোমার প্রতি। আমি চাই তুমি তোমার মেয়েটাকে নিয়ে আজীবন সুখেই থাকো। আমি আমার এই নষ্ট জীবন নিয়েই বেঁচে থাকব। আরেকটা কথা, কখনো যদি জীবন পথে চলতে গিয়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হও আর দেখো সমস্যাটা আমার দ্বারা সমাধান হবে তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে বোলো। আমি তোমাকে সাহায্য করব। এবার আসি জিনিয়া। ভালো থেকো, অনেক ভালো- বলেই দ্রুত বেগে চলে যেতে লাগল সায়েম। পেছন থেকে কান্নামাখা কন্ঠে জিনিয়া বলতে লাগল, সায়েম প্লিজ তুমি যেওনা, আমার আরও কথা আছে, প্লিজ!
কিন্তু সায়েম পেছন ফিরে একটুও না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে যেতে লাগল....
0 মন্তব্যসমূহ