রিলিফ


১. 

বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো ঘরের ছোট্র চৌকিতে শুয়ে আছেন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আসলাম উদ্দিন। হঠাৎ তার ভাতিজা আসক আলী দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল-
-কী হইছে বাজান? এত হাঁপাইতেছ ক্যান?
-কাকা, খবর শুনেছ? আমাগো নদীটার বাঁধ এইবার মনে হয় ভাইঙ্গা যাইব! বাঁধের উপর দিয়া পানি উপচাইয়া পড়তাছে। বাঁধ ভাইঙ্গা গেলেই বেবাক জমি-জামা ডুবাইয়া আমাগো হগলের ঘরবাড়ি ডুবাইয়া দিব!
-কী কইতাছসরে আসক? এখন তাইলে কী অইব?
-কাকা, গাঁয়ের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিছে হগলে মিইল্যা নাকি বাঁধ আটকাইতে যাইব। মেম্বর, চেয়ারম্যান হগলেই যাইতেছে বাঁধের কাছে। আপনে থাকেন। আমিও যাই কাকা- বলেই আবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল আসক আলী।

২. 

আসলাম উদ্দিন ভাবছে এইবার আর রক্ষে নেই। যতই চেষ্টা করুক বাঁধ ভাঙা ঠেকানো যাবে না। বন্যা এবার হবেই। আজ চারদিন ধরে ক্রমাগত মুষলধারে যে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে নদীর পানি বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ২৪ বছর আগে ঠিক এভাবেই নদীর বাঁধ ভেঙে একটা বড় বন্যা হয়েছিল। সেই বন্যার কথা আসলাম উদ্দিনের পরিষ্কার মনে আছে। আর মনে থাকবেইনা বা কেন? সেই বন্যায় যে তার একমাত্র ছেলে আব্বাস মারা গিয়েছিল!

ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে আসলাম উদ্দিনের। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এভাবেই নদীর বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়িতে পানি এসে বন্যা হয়েছিল। আসলাম উদ্দিন তখন পানি থেকে বাঁচতে গ্রামের অনেকের মত বাঁশ দিয়ে ঘরের উঠোনে উঁচু একটা মাচা বানিয়ে সেখানে স্ত্রী আর ছেলে সাত বছরের ছেলে আব্বাসকে নিয়ে কোনমতে বাস করছিল। দিনমজুর আসলাম উদ্দিন সপ্তাহখানেক কাজ না পাওয়ায় ঘরের খাবার দাবাড় ফুরিয়ে গিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে দুদিন উপোস ছিল। হঠাৎ শুনল গাঁয়ে নাকি সরকারি রিলিফ এসেছে। চাল ডাল বিতরণ করবে। শুনে আসলাম উদ্দিন নৌকায় করে ছেলে আব্বাসকে নিয়ে রিলিফ আনতে গেল। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে যেখানে রিলিফ বিতরণ হবে সেখানে ছেলেকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আসলাম উদ্দিন কাজের সন্ধানে বাজারের দিকে চলে গেল। ছেলেকে চাচাতো ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে গেল। কিন্তু ভুলটা এখানেই করল। কারণ রিলিফ বিতরণ শুরু হতেই ক্ষুধার্ত মানুষগুলো কে কার আগে নিবে তা নিয়ে তাড়াহুড়ো আর ধস্তাধস্তি শুরু হলো। ফলস্বরুপ মারামারি বেঁধে গেল দুটি দলের মধ্যে। সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে মাথায় বেশ কয়েকটি লাঠির আঘাত পড়ল আসলামের ছেলে আব্বাসের। ছেলেকে হাসপাতালে নেয়া হলো। কিন্তু শেষ রক্ষে হলো না আসলাম উদ্দিনের।

৩. 

আসলাম উদ্দিন ভাবনার অতলে হাবুডুবু খায়। তার মনে পড়ে, কত সাধনার ধন ছিলো ছেলেটা তার। রশিদা বানুর সাথে তার বিয়ের চার বছর পরও যখন কোন সন্তান হচ্ছিল না তখন কত কবিরাজ দেখিয়েছে, কত মাজারে মান্নত করেছে। কিন্তু কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছিল না তখন সবাই পরামর্শ দেয় রশিদা বানুকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করার। কিন্তু আসলাম উদ্দিন তাতে রাজি হয় না, এভাবে দুই বছর চলার পর হঠাৎ সুসংবাদ আসে যে রশিদা বানুর সন্তান হবে। শুনে আসলাম উদ্দিন কী যে খুশি হয়। এরপর তার ভাঙা ঘর আলোকিত করে আসে আব্বাস উদ্দিন। ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল আসলাম উদ্দিনের। কিন্তু কিছুই পূরণ হলো না। আজ যদি তার ছেলে বেঁচে থাকত তাহলে এই শেষ বয়সে এসে ভাতিজার আশ্রয়ে অর্ধাহারে অনাহারে হয়তো তার জীবনটা কাটাতে হতো না। কিন্তু বিধাতার লিখন যে খণ্ডন যায় না। রশিদা বানু তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আসলাম উদ্দিনের যে মরণও আসে না!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ